Sunday, February 8, 2015

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি:
ভারতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যা করতে পারেনি, বিজেপি সরকার তা সফল করতে পারে৷ আর সেটা হলো - বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সুসম্পর্ক৷ প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্বাভাবিক সুসম্পর্ক বজায় রাখাটা শুধু কূটনৈতিক সৌজন্যবোধের কারণে নয়, বরং সেটা দুই দেশের জন্যেই সমান লাভজনক হতে পারে, তা নিয়ে সংশয় কোনো পক্ষেরই ছিল না৷ ভারতের দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগও ছিল যথেষ্ট, যার পরিণতিতে ২০১১ সালে ভারতের পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর, যেসময় দু'দেশের মধ্যে সাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময় চুক্তি৷ কিন্তু জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সেই চুক্তি অনুমোদন করানো সম্ভব হয়নি ইউপিএ-র পক্ষে৷ সে সময় বর্তমানে ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এবং পশ্চিমবঙ্গে এখন ক্ষমতায় থাকা মমতা ব্যানার্জির দল তৃণমূল কংগ্রেস ওই হস্তান্তর চুক্তির বিরোধিতা করেছিল৷ তৃণমূল কংগ্রেস তখন বাংলাদেশের সঙ্গে প্রস্তাবিত তিস্তা জলবণ্টন চুক্তিরও বিরোধিতা করেছিল এবং প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার পূর্বসিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি৷ তখন বিজেপির আচরণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একটা ধারণা হয়েছিল যে ভারতে যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে৷ উত্তর-পূর্ব ভারতে নির্বাচনি প্রচারে গিয়েও বিজেপি নেতারা যেভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ ইস্যু খুঁচিয়ে তুলছিলেন, তাতে সেই আশঙ্কাই আরও জোরালো হয়েছিল৷ কিন্তু বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গড়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বোঝা গেল, পুরোটাই ছিল সংসদে ইউপিএ সরকারকে বেকায়দায় ফেলা বা অনুপ্রবেশ ইস্যু খুঁচিয়ে তুলে নিজেদের ভোট বাড়ানোর রাজনৈতিক কৌশল৷ বরং নতুন মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের আমন্ত্রিত জানিয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুরুতেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি সার্ক জোটের পুনরুত্থান চান৷ সেই জোটে বাংলাদেশকেও যে প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়ে পাশে চান প্রধানমন্ত্রী মোদী, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের প্রথম সরকারি বৈদেশিক সফর থেকে, কারণ তিনি প্রথমেই ঢাকা গিয়েছিলেন৷ আর সেই সফরে বেশ কিছু ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন বিদেশমন্ত্রী স্বরাজ, যাতে বোঝা গেল, বাংলাদেশের সঙ্গে এক দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ার কথা ভাবছে ভারতের মোদী সরকার৷ সেই ভাবনারই বাস্তবায়ন হলো জাতীয় সংসদে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি পাস করিয়ে নেওয়া৷ বলা বাহুল্য, ভারতের পূর্বতন ইউপিএ সরকারের জোটসঙ্গীদের তুষ্ট রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল, কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকারের তা নেই৷ ফলে ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তি সংসদে অনুমোদন করাতে তাদের বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি৷ কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, ভারতের স্বাধীনতার পর প্রায় ৭০ বছর ধরে যে সমস্যা ছিল বাংলাদেশ সীমান্তে, তা মেটানোর আন্তরিকতা ভারতের কোনো সংখ্যাগরিষ্ট সরকারের তরফেও দেখা যায়নি৷ যৌথভাবে সীমান্তপার সন্ত্রাসের মোকাবিলা, বাণিজ্যিক করিডোর তৈরি করা, দু'দেশের মধ্যে ভিসা সংক্রান্ত নিয়মকানুন সহজ করার মতো এরও একাধিক ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকারের সদিচ্ছা নজরে পড়ছে৷ কাজেই ২০১৪ সালের পর এটা বলাই যায় যে, ২০১৫ সাল ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও গতি আনবে, পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিতও আরও মজবুত হবে৷ দু'দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চলতি ২০১৪ সালও শেষ হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আবদুল হামিদের শুভেচ্ছা সফরের মধ্য দিয়ে৷ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ভারতে আসেন রাষ্ট্রপতি হামিদ, আতিথ্য গ্রহণ করেন নতুন দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে এবং সৌজন্য সাক্ষাত করেন সরকারপক্ষের বিশিষ্টদের সঙ্গে৷ এ সবকিছু কিন্তু ইঙ্গিত করছে দু'দেশের মধ্যে এক নতুন সৌহার্দ সম্পর্কের নবজাগরণের, যা সম্ভবত দু'দেশেরই সাধারণ মানুষের কাছে পরম কাম্য৷ 

ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান ট্রানজিট
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল ও ভুটানের মধ্যে মোটরযান ট্রানজিটের জন্য ফেব্রুয়ারি ২০১৫ মাসে কলকাতায় একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছেবৈঠকে এই চার রাষ্ট্রের মধ্যে স্থলপথে মোটরযান চলাচলের জন্য ট্রানজিট চুক্তির রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত টি অভিন্ন পাঁচটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছে। বিষয়গুলো হল দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, ট্রানজিট, যোগাযোগ ও দুদেশের জনগণের সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ। এই পাঁচটি বিষয়কে ব্যবহার করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরো মজুবত হতে পারে।


বাংলাদেশ-ভারত হাইকমিশনার সম্মেলন

১৪-১৫ নভেম্বর, ২০১৪ ঢাকায় দুই দিন ব্যাপী বাংলাদেশ-ভারত হাইকমিশনার পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নে দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তুলতে ৯ দফা সুপারিশ করেছেন উভয় দেশের বর্তমান ও সাবেক হাইকমিশনাররা। সুপারিশে তারা বলেছেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক ঐতিহ্যগতভাবেই সুদৃঢ়। 


ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে উভয় দেশের অমীমাংসিত ইস্যু সমাধান, বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং সার্ক-বিমসটেকসহ আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে ফলপ্রসূ প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে হবে। এছাড়া নিরাপত্তার বিষয়েও উভয় দেশকে উদ্যোগ নিতে হবে। এভাবে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসে গড়া সম্পর্কের মাধ্যমে দুই দেশ সবচেয়ে লাভবান হবে।
ওই সুপারিশে বলা হয়, অমীমাংসিত বিষয়ে সামগ্রিক বোঝাপড়া ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ এবং ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে দুই দেশকেই উভয় দেশের প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে উভয় দেশের মধ্যকার শিক্ষা, তথ্য ও বাণিজ্যিক বিনিময় বাড়ানোর ওপরও নজর দিতে হবে।

ঢাকা ঘোষণায় বলা হয়, বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করতে হবে। উভয় দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সমঝোতায় আসতে হবে।

সুপারিশে বলা হয়, উভয় দেশের সম্পদ ও সেবা খাতের সুবিধা ব্যবহার করে দুই দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ ও জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি দুই দেশের বিনিয়োগের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে।

এছাড়া দুই দেশের হাইকমিশনারদের ৯ দফা ঢাকা ঘোষণায় পারস্পরিক গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ককে আরো ভালো করার আহ্বান জানানো হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সহযোগিতার খাত সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের কথাও বলা হয় সুপারিশে।


No comments:

Post a Comment