Sunday, February 8, 2015

টিকফা


টিকফা কী
টিকফা শব্দটি নতুন। আগে এর নাম ছিল টিফা।টিফাচুক্তি হলো Trade and Investment Framework Agreements বা সংক্ষেপে TIFA, যেটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে হয় — ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতাচুক্তি। টিফাচুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে গত বারো বছর আগে থেকে। এই চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা সম্বলিত চুক্তিটির প্রথম খসড়া রচিত হয় ২০০২ সালে। পরে ২০০৪ সালে এবং তারও পরে আবার ২০০৫ সালে খসড়াটিকে সংশোধিত রূপ দেয়া হয়। দেশের বামপন্থি শক্তিসহ অন্যান্য নানা মহলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে চুক্তিটি স্বাক্ষর করা এতদিন বন্ধ ছিল। চুক্তির খসড়া প্রণয়নের পর সে সম্পর্কে নানা মহল থেকে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো সামাল দেয়ার প্রয়াসের অংশ হিসেবে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে এটিকে এখন টিকফাতথা TICFA বা Trade and Investment Co-operation Framework Agreement (‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতাচুক্তি) হিসাবে আখ্যায়িত করার হচ্ছে।
বিশ্ব রাজনীতিতে ভারত:
ভারতে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসীন। মোদীর জয়লাভ ও সরকার গঠন আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় পরিসরে নানান পরিবর্তন ও ছাপ ফেলেছে। আগের কংগ্রেস সরকারের বিদেশনীতিতে মোদীর নতুন সরকার মৌলিক কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসতেছে।
বিগত কংগ্রেসের নীতির মূল ফোকাস ছিল নিরাপত্তাএকে কংগ্রেস নীতির ভারকেন্দ্র গণ্য করলে ভুল হবে না। এর পরিবর্তে মোদির নীতির মুল ফোকাস অর্থনীতিভারতের বিদেশ নীতির অভিমুখ কোথায় বদলাতে পারে সেটা বোঝার জন্য এভাবে ভাবা যেতে পারে। মোদি এই নির্বাচনের প্রচারের সময় থেকেই তার নীতির ভারকেন্দ্র অর্থনীতি এই ধারনা দিচ্ছিলেন।
কংগ্রেস নীতির নিরাপত্তাধারণাটিকে ভেঙ্গে অর্থ করলে সেটা দাঁড়ায় পড়শীদের উপর আগ্রাসী বা হকিস নীতি যা চীন অবধি বিস্তৃত; আর ভারতের ভিতরেও যেকোন বিচ্ছিন্নতাবাদী ইস্যুতে সেকুলারিজমের আড়ালে সামরিক জবরদস্তির পথে চাপিয়ে দেয়া সমাধানের উপর অতি নির্ভরতা।
আগের কংগ্রেসের ইউপিএ জোট সরকার একনাগাড়ে দুই টার্ম অর্থাৎ ১০ বছর (২০০৪-২০১৪) ক্ষমতায় ছিল। একে আমরা বলতে পারি বড় দাদাদের যুগ। সেটা কেমন? এর শুরুটা ছিল আমেরিকার যুদ্ধবাজ জর্জ বুশের ওয়ার অন টেররেরঅনুরূপ নীতি, নাইন-ইলেভেন পরবর্তী যুগ। বলা বাহুল্য এটা কংগ্রেসের নিরাপত্তামুখীনীতি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে প্রধান প্রভাবক এবং সহায়কও ছিল। বুশেরও আট বছরের দুই টার্মের সেই যুগে (২০০১-২০০৯) ভারতের ওপর আমেরিকার প্রভাব-সম্পর্ক তৈরি হবার যুগ।
বিপরীতে মোদীর নীতিতে অর্থনীতিমুল ফোকাস। সরকারের মুখ্য কর্তব্য কাজ সৃষ্টি আর সেটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়েই সম্ভব, পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় সেটা বহুজাতিক বিনিয়োগের মধ্য দিয়েই হতে হবে মোদির অর্থনীতিবাদকে ভেঙে বুঝতে চাইলে এভাবেই আমাদের বুঝতে হবে। কাজ সৃষ্টিকে অর্থনৈতিক উন্নতির কেন্দ্রবিন্দু মানার অর্থ অবকাঠামো ও আনুষঙ্গিক বিষয়সহ উন্নয়নের দিকে মুল মনোযোগ ধাবিত করা, তাকেই চালিকাশক্তি মেনে পরিচালনা করা
ভারতের বিদেশ নীতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে, মোদির নীতি বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খুবই সামঞ্জস্যপুর্ণ। এর বিশেষ তাৎপর্য আছে। দুনিয়ায় গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের এক অর্ডারের মধ্যে ১৯৪৪ সালের পর থেকে আমরা যে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে বাস করছিলাম এশতাব্দীর শুরু থেকে -- বিশেষ করে গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে তার বিন্যাসের মধ্যে ক্রমশ স্পষ্ট দৃশ্যমান রূপান্তর দেখা দিতে শুরু করেছে । এটা শুধু বিশ্ব অর্থনীতির অভিমুখ পশ্চিমমুখিতার বদলে পুর্ব দিকে ঢলে পড়া নয়; কিম্বা শুধু চীনের উত্থান কিম্বা চীনসহ অন্তত পাঁচটা রাইজিং ইকোনমিরউত্থানও নয়, এটা একই সাথে এক কেন্দ্রিক দুনিয়ার ক্রম অবসানের ইঙ্গিত। আমেরিকান পরাশক্তিগত ক্ষমতার শাসনের বদলে চীনকে মুখ্য করে অন্তত আরও চার-পাঁচটা রাষ্ট্রের পরাশক্তিগত উত্থানে তা ভাগ হওয়া আসন্ন। এর ফলে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের চরিত্রে বদল হবে সেটা ভাবার কোন কারন নাই। এতদিন অবধি বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য আমরা বহাল দেখে এসেছি। ১৯৪৪ সাল থেকে আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর মত প্রতিষ্ঠান খাড়া করে এবং তাদের প্রাতিষ্ঠানিক বিধি বিধানের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ষ্ট্র্যাটেজিক অর্থনৈতিক স্বার্থ অক্ষূণ্ণ রাখতে পেরেছে। আমেরিকার নেতৃত্বে বিশ্ব অর্থনীতি পশ্চিমাভিমূখী করে সাজানো হয়েছিল; তা এবার ভেঙ্গে পড়ার আলামত শুরু হয়েছে, নতুন নতুন গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানের জন্ম হচ্ছে, নতুন ভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিন্যাস ঘটছে। ধারনা করা যায় পরিশেষে নতুন ধরণের এক বিশ্ব অর্থনৈতিক শৃংখলার জন্ম হবে। সেই শৃংখলার নতুন বিধি বিধান আইন কানুনও থাকবে। এটা আসন্ন, চারদিকে আলামত ফুটে উঠছে।
নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক শৃংখলায় আমাদের মত দেশগুলো জন্য শ্বাস নেবার তুলনামূলক বড় জায়গা মিলবে, এটাই কমবেশী অধিকাংশ অর্থশাস্ত্রবিদদের ধারণা। যেকোন আন্তর্জাতিক চুক্তি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য তুলনামূলক ভাবে বেশি ফেভারবল হবে। প্রতীকিভাবে বললে, অবকাঠামোগত ঋণ পাবার ক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ডব্যাংক আর একছত্র কর্তৃত্ব খাটানোর প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকবে না, থাকছে না। শুরু হয়েছে সমান্তরাল অবকাঠামো ঋণ পাবার প্রতিষ্ঠান। সেটা বোঝা যায় Asian Infrastructure Investment Bank (AIIB), এবং BRICS ব্যাংকের আবির্ভাব দেখে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এই দুই প্রতিষ্ঠানের আলাদা আলাদা ভুমিকা রয়েছে। BRICS অবশ্য শুরুতে আপাতত একই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডাবল ভুমিকা পালন করে দুটোরই বিকল্প হতে চাইছে।
আর সবচেয়ে বড় কথা, গ্লোবাল অর্থনীতির এই পাশ ফেরা মোচড় দেয়া যেটা শুরু হয়েছে সেই অভিমুখের আর উল্টাপথে চলার সম্ভাবনা নাই। চীনের অর্থনীতি ক্রমশ বড় থেকে আরও বড় উদ্বৃত্ব অর্থনীতির দেশ হচ্ছে, ফলে চীনের এই বিশাল বিনিয়োগ সক্ষমতার কারণে আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যংক টাইপের বিকল্প নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার শর্ত হাজির হয়েছে। ওদিকে এমন বিনিয়োগ সক্ষমতার ক্ষেত্রে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পশ্চিমের সক্ষমতা ততই কমছে।
তাহলে এখন প্রশ্ন, আমেরিকা কি নিজের কবর খননের এই ফেনোমেনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে? স্বভাবতই এই জবাব হল না। আমেরিকা এর জন্য অনেকখানি নির্ভর করছে ভারতের উপর। ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের উপর। কিভাবে? তা আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, আমেরিকা চায় ভারত  পুরান গ্লোবাল অর্ডারের প্রতিষ্ঠান আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যংকের আয়ু লম্বা করুক, সেজন্য AIIB , এবং BRICS ধরণের বিকল্প প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চীনের সাথে সক্রিয় উদ্যোক্তার ভুমিকা না নেক। এভাবে ঢলে পড়া পুরান প্রতিষ্ঠানগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার হাত থেকে বাঁচাক। বিনিময়ে আমেরিকা কি অফার করতে পারে? বা কি দেখিয়ে ভারতকে প্রলুব্ধ করছে?
ভারতের  বাসনাঃ সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের লজিস্টিক
আমেরিকার কাছ থেকে ভারতের পাবার সবচেয়ে লোভনীয় দিকটি হচ্ছে ভারতের সামরিক বাহিনীকে সক্ষম করবার জন্য আমেরিকান সহযোগিতা পাওয়া। রাজনৈতিক দিক থেকে আকাংখা দিল্লী-ওয়াশীংটন সম্পর্কের অনেক খানি নির্ধারণ করে। বুশের আমলের ভারত-আমেরিকার সখ্যতার শুরুতে সেই সম্পর্ক রচনার একটি প্রধান উপাদান ছিল ভারতে অস্ত্রের সরবরাহকারি হিসাবে উৎস হিসাবে আমেরিকার প্রবেশ। পারমাণবিকসহ সবকিছুতেই সামরিক সহযোগিতা চুক্তি হয় ২০০৫ সালে। কয়েক যুগ ধরে অস্ত্রের ক্ষেত্রে ভারত মুলত রাশিয়া নির্ভর হয়ে ছিল।এই চুক্তিগুলো ২০০৫ সালে যখন হয় তখন আমেরিকার উস্কানিতে এবং ভারতেরও মনে মনে যে চীন নিয়ে ভীতি ছিল এই পটভুমিতে ঘটেছিল। সামরিক সক্ষমতা থাক আর না থাক ভারতীয় মিডিয়া বলে থাকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতাটা ভারতের কাছে এখনও একটি ট্রমা হয়ে থেকে গেছে। কিন্তু পুরানা মনের টেনশনে নয় এখন চীন-ভারতের স্বার্থ সংঘাতের প্রধান ইস্যু চীন-ভারতের দীর্ঘ সীমান্তের অনেক জায়গা অচিহ্নিত বা বিতর্কিত থেকে যাওয়া। সম্ভাব্য স্বার্থ-বিরোধের জায়গাটা এটাই। কিন্তু ইতোমধ্যে এই ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতিও সাধিত হয়েছে।
কিন্তু এতকিছুর পরও চীন-ভারতের সীমান্ত বা যুদ্ধ বিষয়ক টেনশন বা ট্রমা যাই বলি সেটা যায় নি।
এর সম্ভাব্য একটা কারণ, আমেরিকা। গত দশ বছরে ভারতীয় ইন্টেলিজেন্সিয়া --জনমত বা পলিসি অবস্থান যারা তৈরি ও প্রভাবিত করে-- তাদের করা গবেষণা, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি যা কিছু হয়েছে তা গড়ে উঠেছে আমেরিকার হাত ধরে অথবা কোন না কোন কোন ধরণের মার্কিন সহযোগিতায়।
নেহেরুর আমল থেকে ভারতের একটা নীতি হল, ইন্ড্রাস্টিয়াল পণ্য বিদেশ থেকে সরাসরি আমদানি না করে বরং সরবরাহ কোম্পানীর সাথে ভারতীয় কোম্পানীর যৌথ উদ্যোগে লোকালি ঐ পণ্য বানানোর কারখানা করা। ভারতের জনসংখ্যা বড় ফলে বাজারও বড় বলে এই ধরণের নীতি সফল হয়েছে কমবেশি। কিন্তু অস্ত্র, সামরিক সরঞ্জাম উড়োজাহাজ নৌজাহাজ সংগ্রহ করার বেলায় একই নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে ভারতের অসফলতা সীমাহীন। অসফলতার কারণ বিবিধ। ভারতীয় স্টিলের কোয়ালিটি, অথবা ম্যানেজমেন্টের অক্ষমতা, সামরিক বিষয়ক সবকিছুই সরকারি মালিকানাধীন কারখানা প্রতিষ্ঠান বলে ইত্যাদির অদক্ষতাসহ জানা অজানা সম্ভাব্য কারণ যাই হোক -- শেষ কথায় ভারতের সামরিক সরঞ্জাম স্থানীয় ভাবে উৎপাদনের প্রজেক্ট ফেল করেছে।
সেকথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় গত ২৪ জুন ২০১৪ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এক রিপোর্টে থেকে। রিপোর্ট বলছে, “The problem is with technology, quality as well as cost and delivery schedules”গত ৩০ মার্চ ২০১৩ প্রভাবশালী ইকোনমিষ্ট একই বিষয়ে আলোকপাত করে বলছে, “The defence ministry is chronically short of military expertise”ভারতে সামরিক হার্ডওয়ার সংগ্রহ অর্জনের দুর্বলতার বিষয়টা নীতি বিষয়ক কাগজপত্রে সামরিক খাতে আত্মনির্ভরতাবা সেলফ রিলায়েন্সশব্দে আলোচনা করা হয়। গত বছর ১৪ মে ২০১৩ দি হিন্দু পত্রিকা লিখছে, “The government has finally started taking small steps to change procurement policy but what is required is to free it from the inefficient public sector”অর্থাৎ অদক্ষ সরকারি মালিকানাধীন সামরিক উৎপাদক কারখানাগুলোকে সব সমস্যার গোড়া মনে করছে। এছাড়া কোন সামরিক কারখানায় আগে ২৬% পর্যন্ত বিদেশি মালিকানা থাকতে পারত যা বাডিয়ে ২০১৩ সালে ৪৯% করাতে এটাকে সামরিক হার্ডওয়ার সংগ্রহ বা প্রকিউরমেন্ট নীতিতে খুবই সামান্য পদক্ষেপবলে বর্ণনা করছে। সামরিক উতপাদন খাতে আত্মনির্ভরতারবুলির ভারে ভারতের সামরিক সক্ষমতা কিভাবে ধুঁকছে তা ধারণা করা যায় এসব রিপোর্ট থেকে।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের অস্ত্র সরঞ্জাম পাবার নির্ভরযোগ্য সম্ভাব্য প্রধান উৎস আমেরিকা এমন ইমাজিনেশনের বাইরে অন্য কিছু কল্পনা করাও ভারতের সংশ্লিষ্ট লোকেদের জন্য খুব সহজ নয়। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্টের ভারত সফরে মোদী জাপানের সাথে প্রতিযোগিতা লাগিয়ে চীনের বিনিয়োগ হাসিল করেছেন। ফলে বাণিজ্যিক বা অর্থনৈতিক মূলক গভীর সম্পর্ক চীনের সাথে ভারতের অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু সামরিক সহযোগিতার দিকটা বাদে। অস্ত্র, অস্ত্রের টেকনোলজি, হাইটেক ইত্যাদির ক্ষেত্রে ভারত চীনের ওপর নির্ভর থাকবে না, কিম্বা থাকতে চাইবেও নাআগামীতে ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সামরিক সক্ষমতার যে প্রয়োজন দেখা দিবে তাতে কোন সামরিক সহযোগিতার বিষয় চীনের সাথে ঘটা অসম্ভব। কারণ সামরিক সংঘাত চীনের সাথে ঘটবার সম্ভাবনা থাকায় চীনের সাথেই আবার ভারতের সামরিক সহযোগিতা হবার সম্ভাবনা সেটা নাকচ করে। সামরিক ইস্যুর এই বাস্তবতার দিকটার জন্য ভারতের রাজনৈতিক দল, নেতা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যুক্ত যে কেউই আমেরিকান সহযোগিতা পাবার আশা ত্যাগ করে অন্য কিছু ভাবতে পারে নাতাদের লোভের জায়গাতা এখানে। ফলে মার্কিন সামরিক সহযোগিতা --- এটাই আমেরিকার কাছে ভারতীয়দের মনোবাসনা। মোদিরও বটে।
এই কামনা পূরণে ভারত কতদুর আমেরিকার কাছে ধরা দিতে পারে? কামনা পূরণের বিনিময়ে ভারত আমেরিকার কাছে নিজের কোন স্বার্থ এবং কতটা ছাড় দেয়া সঠিক গণ্য করবে। এই মাত্রা নির্ণয়ও ভারতের জন্য খুবই জটিল ও গুরুত্বপুর্ণ বিষয়।
Asian Infrastructure Investment Bank (AIIB), এবং BRICS ব্যাংকে ভারতের অংশগ্রহনের বিষয়টিই এখানে মূখ্য ভূমিকা পালন করবে বলে বিশ্লেষকগণ মনে করেন।

বিশ্ব রাজনীতিতে চীন:

সাম্প্রতিক কালে চীনের যে উত্থান তা নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিতর্ক চলছে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে। আমরা জানি যে, ১৯৭৮-৮৯ সাল থেকে চীনের আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া চলছে। সেই আধুনিকায়নের পথ ধরে '৯০ এর দশকে চীন একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে বিশ্বে আবির্ভুত হয়েছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের এই উত্থান লক্ষ্য করা যায়। নব্বই দশকের শুরুতে চীনে যে অর্থনৈতিক উত্থান শুরু হয় তা ধারাবাহিকভাবে চলছে। চীন যে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান করে নিয়েছে তারই একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে, গত বছর চীন জাপানকে পিছনে ফেলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রমান করতে সক্ষম হয়েছে। এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই যে, বর্তমান বিশ্বে চীন অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি। চীনের এই অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। অনেক আগে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা জরিপ করে বলেছিল যে, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে চীন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে ভারতকে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। বর্তমানে যে সব রাষ্ট্র শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত যেমন, যুক্তরাষ্ট্র,জাপান, জার্মানি ইত্যাদি তাদের অবস্থান হারাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থার সেই ভবিষ্যত বাণী চীনের ক্ষেত্রে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে, আজ চীন বিশ্বের ১ নম্বর অর্থনীতির দেশদ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকেই চীন সামরিক দিক থেকে বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে বিবেচিত। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীন যখন পরিচিত ছিল তখনও তার সামরিক শক্তি ছিল। চীনের সামরিক শক্তি আমরা কোরিয়ান যুদ্ধে দেখেছি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় চীনের সামরিক শক্তির পরিচয় আমরা পেয়েছি। আশেপাশের যে কোনো দেশের সংঘাতের ক্ষেত্রে চীনের সামরিক গুরুত্বের পরিচয় আমরা পেয়েছি। সামরিক শক্তি হিসেবে চীনের যে উত্থান তাও অবশ্যম্ভাবী ছিল। চীন অনেক আগে থেকেই সামরিক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে বিবেচিত ছিল। সামরিক শক্তির সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক শক্তি যখন যোগ হলো তখন স্বাভাবিক কারণেই চীনের সামরিক শক্তি বহুগুনে বৃদ্ধি পায়। চীনকে বলা হয়, ব্লু ওয়াটার নেভি। ব্লু ওয়াটার নেভি বলা হয় সেই দেশকে যার ব্যাপক নৌ-শক্তি আছে এবং সে তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারে। বিশ্বের খুব কম রাষ্ট্রের এ ধরনের নৌশক্তি আছে এবং তা যথার্থভাবে প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখে। আমরা জানি চীনের ব্যাপক জলসীমা আছে এবং তারা তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব বাস্তবতা চীনের জন্য অনেক বেশি অনুকূলে ছিল। এখনো তা চীনের অনুকূলে রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব বাস্তবতার কারণেই চীনের এই বিস্ময়কর উত্থান ঘটছে। চীনের এই উত্থানের প্রভাব পড়ছে চীন যে অঞ্চলে অবস্থিত সেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপর। পরবর্তীতে আমরা এই প্রভাব পুরো এশিয়াতে এই প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন কি বিশ্ব রাজনীতিতেও এর একটি প্রভাব আমরা লক্ষ্য করছি। চীনের এই বিস্ময়কর উত্থানের কারণে যে দেশগুলো কিছুটা হলেও শঙ্কিত হয়ে পড়েছে তার মধ্যে সবার আগে উলেখ করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের কথা। ১৯৭২ সালের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। চীন-মার্কিন সুসম্পর্কের মধ্যেও চীনের উত্থান ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্কও এ দেশটির সামরিক এবং অর্থনৈতিক উত্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। সামরিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান দক্ষিণ এশিয়া এবং প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। কিছুটা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। শুধু এশিয়াতেই নয়, আফ্রিকাতেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রভাব বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে চীন সব সময়ই শান্তির কথা বলে। চীন সব সময়ই শান্তির নীতি অনুসরণ করে চলেছে। তাই সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করছে না। চীনের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না। যেমন,আমরা যদি ইরানের ব্যাপারটি লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো, ইরানের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারছে না। '৯০ দশক থেকে চীন রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছে। এক সময় চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যে শত্র"তাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তা থেকে দেশ দুটি বেরিয়ে আসছে। চীন ও রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেশ দুটি তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে। হয়তো চীন ও রাশিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয়তো নাটকীয় কোনো কিছু ঘটেনি কিন্তু তারা এই সম্পর্ককে দু'দেশের মধ্যে ব্যালেন্স রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে। এই সুসম্পর্কের কারণেই জাতিসংঘে অনেক ইস্যুতেই দেশ দু'টি একই অবস্থান গ্রহণ করে। লিবিয়া, ইরান এবং সিরিয়ার ক্ষেত্রেও এটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসব দেশের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তাদের ইউরোপীয় মিত্ররা যতটা চাপ প্রয়োগ করতে চায় বা শক্তি প্রয়োগ করতে চায় তা তারা পারছে না। এর পেছনে চীনের নীতগত অবস্থান যেমন রয়েছে তেমনি স্বাতন্ত্র বজায় রাখার একটি প্রয়াসও লক্ষ্য করা যায়। পূর্ব এশিয়াতেও চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের সঙ্গে সাউথ কোরিয়ার সম্পর্ক আরো জোরদার হয়েছে। জাপানের সঙ্গে চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েন থাকলেও তারা সম্পর্ক উন্নয়ন করছে। অবশ্য এই সম্পর্ক ততটা শক্তিশালী নয়। আমরা জানি যে, জাপানের সঙ্গে একটি বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ঐতিহাসিক কারণেই চীনের সঙ্গে জাপানের প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। অন্য দিক থেকে তাদের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও দেশ দুটির মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে। নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক দিক থেকে তাদের মধ্যে যে গ্যাপ রয়েছে তা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণেই চীনকে তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি দিতে হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার প্রতি চীনের যে সমর্থন তা তারা বজায় রাখছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপান ৬জাতি আলোচনা শুরু করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তা তেমন কোনো কার্যকর হয় নি। এখানে চীনের ভূমিকাটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন তার অবস্থান এবং স্বার্থ থেকে সরে আসছে না। এক সময় চীনের সঙ্গে ভারতের খুবই বন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালের যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে দেশ দুটির মধ্যে বৈরি সম্পর্ক তৈরি হয়। স্নায়ু যুদ্ধের পর ভারত এবং চীনের মধ্যে পুনরায় একটি সুসম্পর্ক তৈরির চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চীন ও ভারতের মধ্যে ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু কিছু দিন ধরে দেশ দুটির মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা গ্যাপ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এই গ্যাপের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে পারমানবিক চুক্তি স্বাক্ষর। যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ঘনিষ্ট হবার কারণে চীনের সঙ্গে ভারতের কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক চীনের জন্য কিছুটা হলেও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। নব্বই এর দশকের শেষ দিকে চীন ,ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সম্পর্ক সৃষ্টির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু নানা কারণেই সেই সম্পর্কটি সৃষ্টি হয় নি। এটা না হবার পেছনে মার্কিন কূটনীতি একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র যতই ভারতের ঘনিষ্ট হচ্ছে চীনের সঙ্গে ভারতের ততই দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের দূরত্ব ক্রমাগত বাড়ছে। 
এমনই এক বাস্তবতায় আমরা দেখছি, চীন তার সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করছে। বলা হচ্ছে, চীন তার সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করেছে ১১.শতাংশ। প্রথমবারের মতো চীনের সামরিক ব্যয় ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। চীনের এই সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি বিশ্বের যেসব দেশ নিজেদের বৃহৎ সামরিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে তাদের জন্য উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। চীনের যে রাজনৈতিক আকঙ্খা,তার যে সামরিক আকাঙ্খা তা বাস্তবায়িত করার জন্যই দেশটি তার সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করে চলেছে। চীন যে একটি পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভুত হচ্ছে, চীনকে যেনো কোনোভাবেই অবহেলা করা না হয় তা বুঝানোর জন্যই এই সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। চীন এমন সময় তার সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করছে যখন তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়েন চলছে। ভারতের সঙ্গেও এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে। জাপানের সঙ্গেও চীনের কিছুটা সমস্যা রয়েছে। চীন এমনই এক প্রেক্ষিতে তার সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করছে। চীনকে যখন সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয় তখন সে বলছে,তাদের দীর্ঘ সীমান্ত রক্ষা করা এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিধান করার জন্য সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া তাদের যে ব্যাপক ভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাই তারা একে কোনো নাটকীয় পরিবর্তন বলে আখ্যায়িত করতে রাজি নয়। তারা আরো বলছে, চীনের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই তারা তাদের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করছে। চীনের প্রতিপক্ষ হয়তো এই যুক্তি গ্রহণ করবে না। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন অবশ্যই একটি বিবেচ্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে। চীনের ভূমিকা কোনোভাবেই উপক্ষো করা যাবে না। আগামীতে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং মনোভাবের উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। মালদ্বীপ হতে যুক্তরাষ্ট্র সবাইকে চীনের অবস্থান নিয়ে ভাবতে হচেছ ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে না হলেও দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। যুগ যুগ ধরে যে সব দেশ এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করে আসছিল তাদের চীনকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্র দেশগুলো শত বছর ধরে এই অঞ্চলে যে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে সেখানে চীন একটি শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতে পারে। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ যখন তাদের সামরিক ব্যয় হ্রাস করার চিন্তা করছে তখন চীন তার সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করছে। এ থেকে অনুধাবন করা যায় যে, চীন তার অর্থনৈতিক শক্তির ব্যাপারে কতটা আত্মপ্রত্যয়ী। চীন বিশ্ব অর্থনীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে এতে কোনোই সন্দেহ নেই। প্রতিটি রাষ্ট্রকেই চীনকে এখন বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব এখন আর কারো অজানা নয়। আন্তর্জাতিক শক্তির খেলায় চীনকে একটি বড় খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সাম্প্রতিক গতি-প্রকৃতি:
ভারতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যা করতে পারেনি, বিজেপি সরকার তা সফল করতে পারে৷ আর সেটা হলো - বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সুসম্পর্ক৷ প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের স্বাভাবিক সুসম্পর্ক বজায় রাখাটা শুধু কূটনৈতিক সৌজন্যবোধের কারণে নয়, বরং সেটা দুই দেশের জন্যেই সমান লাভজনক হতে পারে, তা নিয়ে সংশয় কোনো পক্ষেরই ছিল না৷ ভারতের দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগও ছিল যথেষ্ট, যার পরিণতিতে ২০১১ সালে ভারতের পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর, যেসময় দু'দেশের মধ্যে সাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময় চুক্তি৷ কিন্তু জাতীয় সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সেই চুক্তি অনুমোদন করানো সম্ভব হয়নি ইউপিএ-র পক্ষে৷ সে সময় বর্তমানে ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এবং পশ্চিমবঙ্গে এখন ক্ষমতায় থাকা মমতা ব্যানার্জির দল তৃণমূল কংগ্রেস ওই হস্তান্তর চুক্তির বিরোধিতা করেছিল৷ তৃণমূল কংগ্রেস তখন বাংলাদেশের সঙ্গে প্রস্তাবিত তিস্তা জলবণ্টন চুক্তিরও বিরোধিতা করেছিল এবং প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার পূর্বসিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে বাতিল করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি৷ তখন বিজেপির আচরণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের একটা ধারণা হয়েছিল যে ভারতে যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে৷ উত্তর-পূর্ব ভারতে নির্বাচনি প্রচারে গিয়েও বিজেপি নেতারা যেভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ ইস্যু খুঁচিয়ে তুলছিলেন, তাতে সেই আশঙ্কাই আরও জোরালো হয়েছিল৷ কিন্তু বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গড়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বোঝা গেল, পুরোটাই ছিল সংসদে ইউপিএ সরকারকে বেকায়দায় ফেলা বা অনুপ্রবেশ ইস্যু খুঁচিয়ে তুলে নিজেদের ভোট বাড়ানোর রাজনৈতিক কৌশল৷ বরং নতুন মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের আমন্ত্রিত জানিয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুরুতেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি সার্ক জোটের পুনরুত্থান চান৷ সেই জোটে বাংলাদেশকেও যে প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়ে পাশে চান প্রধানমন্ত্রী মোদী, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের প্রথম সরকারি বৈদেশিক সফর থেকে, কারণ তিনি প্রথমেই ঢাকা গিয়েছিলেন৷ আর সেই সফরে বেশ কিছু ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন বিদেশমন্ত্রী স্বরাজ, যাতে বোঝা গেল, বাংলাদেশের সঙ্গে এক দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ার কথা ভাবছে ভারতের মোদী সরকার৷ সেই ভাবনারই বাস্তবায়ন হলো জাতীয় সংসদে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি পাস করিয়ে নেওয়া৷ বলা বাহুল্য, ভারতের পূর্বতন ইউপিএ সরকারের জোটসঙ্গীদের তুষ্ট রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল, কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকারের তা নেই৷ ফলে ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তি সংসদে অনুমোদন করাতে তাদের বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয়নি৷ কিন্তু তার থেকেও বড় কথা, ভারতের স্বাধীনতার পর প্রায় ৭০ বছর ধরে যে সমস্যা ছিল বাংলাদেশ সীমান্তে, তা মেটানোর আন্তরিকতা ভারতের কোনো সংখ্যাগরিষ্ট সরকারের তরফেও দেখা যায়নি৷ যৌথভাবে সীমান্তপার সন্ত্রাসের মোকাবিলা, বাণিজ্যিক করিডোর তৈরি করা, দু'দেশের মধ্যে ভিসা সংক্রান্ত নিয়মকানুন সহজ করার মতো এরও একাধিক ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী মোদীর সরকারের সদিচ্ছা নজরে পড়ছে৷ কাজেই ২০১৪ সালের পর এটা বলাই যায় যে, ২০১৫ সাল ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে আরও গতি আনবে, পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিতও আরও মজবুত হবে৷ দু'দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চলতি ২০১৪ সালও শেষ হলো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আবদুল হামিদের শুভেচ্ছা সফরের মধ্য দিয়ে৷ ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণ রক্ষা করতে ভারতে আসেন রাষ্ট্রপতি হামিদ, আতিথ্য গ্রহণ করেন নতুন দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে এবং সৌজন্য সাক্ষাত করেন সরকারপক্ষের বিশিষ্টদের সঙ্গে৷ এ সবকিছু কিন্তু ইঙ্গিত করছে দু'দেশের মধ্যে এক নতুন সৌহার্দ সম্পর্কের নবজাগরণের, যা সম্ভবত দু'দেশেরই সাধারণ মানুষের কাছে পরম কাম্য৷ 

ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান ট্রানজিট
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশ-নেপাল ও ভুটানের মধ্যে মোটরযান ট্রানজিটের জন্য ফেব্রুয়ারি ২০১৫ মাসে কলকাতায় একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছেবৈঠকে এই চার রাষ্ট্রের মধ্যে স্থলপথে মোটরযান চলাচলের জন্য ট্রানজিট চুক্তির রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত টি অভিন্ন পাঁচটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছে। বিষয়গুলো হল দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, ট্রানজিট, যোগাযোগ ও দুদেশের জনগণের সঙ্গে আন্তঃযোগাযোগ। এই পাঁচটি বিষয়কে ব্যবহার করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরো মজুবত হতে পারে।


বাংলাদেশ-ভারত হাইকমিশনার সম্মেলন

১৪-১৫ নভেম্বর, ২০১৪ ঢাকায় দুই দিন ব্যাপী বাংলাদেশ-ভারত হাইকমিশনার পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নে দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তুলতে ৯ দফা সুপারিশ করেছেন উভয় দেশের বর্তমান ও সাবেক হাইকমিশনাররা। সুপারিশে তারা বলেছেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক ঐতিহ্যগতভাবেই সুদৃঢ়। 


ভবিষ্যতে এ অবস্থা আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে উভয় দেশের অমীমাংসিত ইস্যু সমাধান, বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং সার্ক-বিমসটেকসহ আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে ফলপ্রসূ প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে হবে। এছাড়া নিরাপত্তার বিষয়েও উভয় দেশকে উদ্যোগ নিতে হবে। এভাবে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসে গড়া সম্পর্কের মাধ্যমে দুই দেশ সবচেয়ে লাভবান হবে।
ওই সুপারিশে বলা হয়, অমীমাংসিত বিষয়ে সামগ্রিক বোঝাপড়া ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ এবং ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে দুই দেশকেই উভয় দেশের প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে উভয় দেশের মধ্যকার শিক্ষা, তথ্য ও বাণিজ্যিক বিনিময় বাড়ানোর ওপরও নজর দিতে হবে।

ঢাকা ঘোষণায় বলা হয়, বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করতে হবে। উভয় দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি এই সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সমঝোতায় আসতে হবে।

সুপারিশে বলা হয়, উভয় দেশের সম্পদ ও সেবা খাতের সুবিধা ব্যবহার করে দুই দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ ও জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। পাশাপাশি দুই দেশের বিনিয়োগের ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে।

এছাড়া দুই দেশের হাইকমিশনারদের ৯ দফা ঢাকা ঘোষণায় পারস্পরিক গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ককে আরো ভালো করার আহ্বান জানানো হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সহযোগিতার খাত সম্প্রসারিত করার মাধ্যমে আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের কথাও বলা হয় সুপারিশে।


ইউক্রেন/ক্রিমিয়া সংকট

ক. ইউক্রেন/ক্রিমিয়া সংকটের পটভূমি ও স্বরুপ আলোচনা করুন।
খ. ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সাথে অন্তর্ভূক্তি রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ সম্পর্কে কি ধরণের প্রভাব ফেলবে? আলোচনা করুন।

উত্তর: ক

ইউক্রেন/ক্রিমিয়া সংকট:
ইউরোপিয়ান দেশ ইউক্রেনের একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র ও উপদ্বীপের নাম ক্রিমিয়া। ছোট এই উপদ্বীপটির অবস্থান কৃষ্ণসাগরের উত্তর উপকূলে। আয়তন ২৬ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। বসবাসরতদের বেশির ভাগই রুশপন্থী বা কমিউনিস্ট। ৬০ বছর আগে ক্রিমিয়া ছিল রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা খ্রুশ্চভ ক্রিমিয়া উপদ্বীপটি উপহার হিসেবে লিখে দিয়েছিলেন ইউক্রেনকে। বলতে গেলে তখন থেকেই রুশদের মধ্যে অসন্তোষের শুরু। এরপর বিভিন্ন সময় রাশিয়া ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেও সফল হয়নি। বর্তমান সমস্যার সূত্রপাত হয় ইউক্রেনের রুশপন্থি প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউরোপের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করতে অস্বীকৃতি জানানোর পর গত নভেম্বর ২০১৩ থেকে ।ইউক্রেনের মস্কোপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নপন্থী প্রতিবাদ বিক্ষোভের জেরে পদত্যাগে বাধ্য হন। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ২০০০ সালে প্রথম রাশিয়ার ক্ষমতায় বসার পর থেকেই ন্যাটো জোট বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রভাব থেকে সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোকে মুক্ত রাখার পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত। নিকট প্রতিবেশী ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ যাতে বড় একটি বাণিজ্য চুক্তি করে ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না হয়ে ওঠেন সে জন্যই পুতিন দেড় হাজার কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার টোপ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইউরোপপন্থীদের আন্দোলনে পতন ঘটে ইয়ানুকোভিচের।এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়ান বাহিনী ক্রিমিয়াকে দখলে নিতে গেলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ পরিস্থিতিকে বিশ্বগণমাধ্যম 'ক্রিমিয়া সংকট' হিসেবে অভিহিত করেছে।

এক সময় ক্রিমিয়ার প্রধান জনগোষ্ঠী ছিল তুর্কি বংশোদ্ভূত তাতার। স্টালিনের আমলে তাদের উৎখাত করে সেখানে আশ্রয় দেওয়া হয় রুশদের। বর্তমানে উপদ্বীপটির মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ তাতার, ২৫ ভাগ ইউক্রেনীয় এবং ৬০ ভাগ রুশ। দেশটি কী ইউক্রেনের সঙ্গে থাকবে না রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে- এই প্রশ্নে এক গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৬ মার্চ ২০১৪। ভোটে ক্রিমিয়ার ৯৭ ভাগ জনগণ রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত হওয়ার পক্ষে রায় দেন। এ রায়কে পুঁজি করে ক্রিমিয়ার পার্লামেন্ট ১৭ মার্চ ২০১৪ নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে এবং রুশ ফেডারেশনে যোগ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানায়।তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই গণভোটের বৈধতা দেয়নি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার তীব্র চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে রুশ ফেডারেশনের সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত আইনে স্বাক্ষর করে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার একীভূত অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গত ২১ মার্চ রাশিয়ার পার্লামেন্টের ফেডারেল অ্যাসেম্বলির উচ্চকক্ষে ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তকরণ চুক্তিটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। ফলে আইনসম্মত উপায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিমিয়া এখন রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মধ্য দিয়ে ক্রিমিয়া সংকটের স্থায়ী কোনো সমাধান হবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েই গেছে।


উত্তর: খ

ক্রিমিয়া সংকট প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ বনাম রাশিয়া সম্পর্ক:

ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) রাশিয়ার ওপর দুই দফা নিষেধাজ্ঞা জারির পর কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও সুইজারল্যান্ডও এতে শরিক হয়। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়াও তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশগুলো থেকে খাদ্যসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা নিষেধাজ্ঞার পরিসর আরও বৃদ্ধি করবে। এভাবে পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ অব্যাহত থাকলে তা অচিরেই পুরোপুরি বাণিজ্যযুদ্ধে রূপান্তরিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তখন রাশিয়ার সীমান্তে মোতায়েনকৃত মার্কিন সামরিক বাহিনী ও রাশিয়ার সেনাবাহিনী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে কী অবস্থা দাঁড়াবে? রাশিয়া ইতিমধ্যে ন্যাটোর বিরুদ্ধে তার দেশে কামানের সাহায্যে সাবানের বুদ্বুদ নিক্ষেপের অভিযোগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে ২০ হাজারের বেশি সৈন্য ও অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। রাশিয়ার সৈন্যরা পূর্ব ইউক্রেনে বিদ্রোহীদের সমর্থনে মানবিক সাহায্যের ছদ্মাবরণে ঢুকে পড়তে পারে বলেও তারা মনে করে। এভাবে পাল্টাপাল্টি সামরিক শক্তি সমাবেশ ও তৎপরতার অভিযোগ শেষ পর্যন্ত কি পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নেবে? প্রতিনিয়ত যেভাবে উত্তেজনার পারদ চড়ছে তাতে খালি চোখে সেটাকেই ঘরের দুয়ারে ঘনিয়ে ওঠা বিপদ মনে হতে পারে।

রাশিয়া অবশ্যই চাইবে না ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে তার জন্মের মতো আড়ি হয়ে যাক। সে কারণে গোপনে পূর্ব ইউক্রেনের রুশভাষী বিদ্রোহীদের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের সাহায্য প্রদান করলেও তারা মার্কিন প্ররোচনায় উত্তেজিত হয়ে ইউক্রেন আক্রমণ করতে না-ও যেতে পারে। গবেষক পল ক্রেইগ রবার্টস অবশ্য তাড়াতাড়ি রাশিয়াকে ইউক্রেনের পূর্বাংশ দখল করে নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও পক্ষপাতী। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর বিরুদ্ধে কতিপয় ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও রাশিয়া ইউরোপে জ্বালানি তেল ও গ্যাস রফতানি বন্ধ করতে যাবে বলে মনে হয় না। ইইউ জ্বালানি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি নিজেদের স্বার্থেই। তারা জ্বালানি প্রযুক্তি রাশিয়ায় রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কিন্তু রাশিয়া কি এক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের চেষ্টা বেশ আগে থেকেই শুরু করেনি! রাশিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা ইউরোপকে কাজে লাগাতে পারে, এ আশঙ্কা থেকে থাকবে। সে কারণে তারা অনেক ক্ষেত্রেই পশ্চিমা নির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে সচেষ্ট ছিল এবং এখনও রয়েছে। এটা অনেক দিন থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বস্তুত ভস্ম থেকে উঠে দাঁড়ানো রাশিয়ার আমেরিকার হেজিমনির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা ওয়াশিংটনের কাছে স্পষ্ট হওয়ার পর তারা রাশিয়াকে চেপে ধরার কৌশল নেয়। আর সেটা ভালোভাবেই টের পায় রাশিয়া।

রাশিয়া-ইইউ পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার ফলে উভয়পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলা যায়। উভয়ের মধ্যে মোট বাণিজ্যের (আমদানি-রফতানি) পরিমাণ ২০১২ সালে চারশ' বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি ছিল। উভয় দেশের ব্যবসায়ী ও সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। যুদ্ধজাহাজ তৈরি পর্যন্ত বাণিজ্যিক সহযোগিতা বিস্তৃত। এভাবে চলতে থাকলে ইউরোপ এক সময় রাশিয়ার নির্ভরযোগ্য সঙ্গীতে পরিণত হবে, এ চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রের থাকতেই পারে। আর রাশিয়া যদি ইউরোপকে পেয়ে যায় তাহলে তাকে চ্যালেঞ্জ জানানো অসম্ভব নয় মনে হতে পারে। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চেষ্টা করবেই। বৃহৎ শক্তিবর্গের দাবা খেলায় এ ধরনের হিসাবি চাল তো চলতেই পারে। যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে কিছুটা সফল। সে মালয়েশিয়ার বিমান ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র্র করে ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছে। অথচ যাত্রীবাহী বিমানটি ভূপাতিত করার সঙ্গে রাশিয়া বা তার সমর্থিত বিদ্রোহীরা জড়িত রয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বরং বিমানটিকে জঙ্গি বিমান থেকে মেশিনগানের গুলি ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ধ্বংস করা হয়েছে, এই মত জোরালো হচ্ছে। নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিকেও যুক্তরাষ্ট্র আমলে নিচ্ছে না। এতে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। এটি ইউক্রেনের একটি স্যাবোটাজ কর্মর্র্ নয় তো!

বিশ্ব জায়ান্টদের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা বিশ্বে গড়ে ওঠা পরস্পর নির্ভরশীল অর্থনৈতিকসহ বহুবিধ সম্পর্ককে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এতে আমরাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া এবং ইইউ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে ক্ষেত্রওয়ারি নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার তাৎক্ষণিক ক্ষতিটা বেশি হবে। আর দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস পাবে। কারণ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলার থেকে সরে গিয়ে হংকং ডলার ও চীনের মুদ্রা রিমিমবি বা য়ুয়ান এবং রুবলকে ব্যবহার করবে। চীনের ওপর তার নির্ভরতার পরিমাণ এতে অনেকগুণ বেড়ে যাবে। চীন এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখেও রাশিয়াকে অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমর্থন করবে কি-না সে ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মধ্যে সন্দেহ থাকতে পারে। তবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের জন্য রাশিয়া ও চীনের মধ্যে প্রায় একযুগ থেকেই সমঝোতা ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে। এই দুই শক্তির নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা। বিশ্বের প্রধান বাণিজ্যিক শক্তি ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন রাশিয়ার স্ট্র্যাটেজিক অংশীদার হওয়ায় তার পক্ষে পশ্চিমা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার ধকল কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞাকে হিসাব করেই রাশিয়া চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রায় অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলারের জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদন করেছে। সামরিক খাতেও রাশিয়া-চীন সহযোগিতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাশিয়ার আরেক হাত তো ব্রাজিলসহ লাতিন আমেরিকার দিকে প্রসারিত। ভারতও এতে বাণিজ্য সম্প্রসারণের মওকা পেতে পারে।

চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সংঘাতে জড়ানোর মতো অবস্থা ইইউর নেই। যুক্তরাষ্ট্রও হাজারবার ভাববে। ব্রিক দেশগুলো ইতিমধ্যেই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ন্যায্য হিস্যা না পেয়ে নিজেরাই ব্রিক উন্নয়ন ব্যাংক ও রিজার্ভ ফান্ড গড়ে তুলেছে। এর ফলে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের খবরদারি কমবে। এটি যদি সঠিকভাবে কাজ করে তাহলে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে ন্যায্য হিস্যা প্রদান করতে বাধ্য হবে। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোও উন্নয়নের একটির পর একটি সোপান অতিক্রম করে উন্নত দেশের সারিতে ক্রমাগতভাবে জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ পাবে।

বস্তুত ব্রিকস দেশগুলো গোটা বিশ্বব্যবস্থাকে নতুন অবয়ব দিতে চাচ্ছে বা জেগে ওঠা বহু মেরুর বিশ্বব্যবস্থাকে যাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দুনিয়া মেনে নেয় সে চেষ্টাই করছে। আর আমেরিকা চাচ্ছে তার আড়াই দশকের একচ্ছত্র আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে। এখানেই স্বার্থের সংঘাত শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে সামনাসামনি লড়াইয়ের বিপদ ঘনিয়ে তুলছে। রাশিয়া-আমেরিকা একটা মোকাবেলার পরিস্থিতিতে গেলে এ দুই দেশের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ইউরোপের। এই বোধ নিশ্চয়ই ইউরোপের রয়েছে। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি কী ভয়াবহ হয়েছিল তার দাগ মুছে যাওয়ার নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে যুদ্ধের মধ্যে টেনে নামাতে যতই চেষ্টা করুক না কেন, ইউরোপ চাইবে না রাশিয়া তাতে পা দিক। আর রাশিয়াও সংঘর্ষ বাধানোর মতো অবস্থা সৃষ্টির মার্কিন চেষ্টাকে ভণ্ডুল করে দেওয়ার জন্য ইউরোপকে সঙ্গী হিসেবে এখনও পেতে চায়। সেজন্যই রাশিয়ার ইইউর ওপর নিষেধাজ্ঞাটা এক অর্থে প্রতীকী বলা যায়। রাশিয়া এখনও ইউরোপের দিকে এক হাত বাড়িয়েই রেখেছে। তবে পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার জেরে উভয়ের মধ্যে যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা দূর হবে কী করে, সেটা বিরাট প্রশ্ন হয়েই থাকবে।


রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ইউরোপের নির্ভরতা অদূর ভবিষ্যৎ কাটার সম্ভাবনা নেই। যুক্তরাষ্ট্র যতই আশার বাণী শোনাক না কেন, তার পক্ষে নবলব্ধ পাথুরে তেল ও গ্যাস (শেল অয়েল অ্যান্ড গ্যাস) ইউরোপে রফতানি করা সম্ভব হবে না। তারা তো ২০৩৫ সালের আগে জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারবে না বলে নিজেরাই ঘোষণা দিয়েছে। এই তেল বের করার জন্য খরচ কিন্তু কম নয়। বরং জ্বালানি তেল উত্তোলন করতে সৌদি আরবে যেখানে ব্যারেলপ্রতি ১০ ডলার লাগে সেখানে পাথুরে তেলে খরচ পড়ে কয়েকগুণ বেশি। তদুপরি এই তেলে লাভ অনেক কম বিধায় ইতিমধ্যেই এর বিরুদ্ধে তেল ও গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অসন্তোষ প্রকাশ করা শুরু করেছে। অনেকের লাভের গুড়ের হদিস পিঁপড়ে পর্যন্ত পায়নি!