টিকফা কী?
টিকফা শব্দটি নতুন। আগে এর নাম ছিল টিফা।‘টিফা’ চুক্তি হলো Trade and Investment Framework Agreements বা সংক্ষেপে TIFA, যেটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে হয় — ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি। ‘টিফা’ চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে গত বারো বছর আগে থেকে। এই চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা সম্বলিত চুক্তিটির প্রথম খসড়া রচিত হয় ২০০২ সালে। পরে ২০০৪ সালে এবং তারও পরে আবার ২০০৫ সালে খসড়াটিকে সংশোধিত রূপ দেয়া হয়। দেশের বামপন্থি শক্তিসহ অন্যান্য নানা মহলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে চুক্তিটি স্বাক্ষর করা এতদিন বন্ধ ছিল। চুক্তির খসড়া প্রণয়নের পর সে সম্পর্কে নানা মহল থেকে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো সামাল দেয়ার প্রয়াসের অংশ হিসেবে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে এটিকে এখন ‘টিকফা’ তথা TICFA বা Trade and Investment Co-operation Framework Agreement (‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি) হিসাবে আখ্যায়িত করার হচ্ছে।
২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তিটি স্বাক্ষর করে।
টিকফা শব্দটি নতুন। আগে এর নাম ছিল টিফা।‘টিফা’ চুক্তি হলো Trade and Investment Framework Agreements বা সংক্ষেপে TIFA, যেটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে হয় — ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি। ‘টিফা’ চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে গত বারো বছর আগে থেকে। এই চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা সম্বলিত চুক্তিটির প্রথম খসড়া রচিত হয় ২০০২ সালে। পরে ২০০৪ সালে এবং তারও পরে আবার ২০০৫ সালে খসড়াটিকে সংশোধিত রূপ দেয়া হয়। দেশের বামপন্থি শক্তিসহ অন্যান্য নানা মহলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে চুক্তিটি স্বাক্ষর করা এতদিন বন্ধ ছিল। চুক্তির খসড়া প্রণয়নের পর সে সম্পর্কে নানা মহল থেকে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো সামাল দেয়ার প্রয়াসের অংশ হিসেবে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে এটিকে এখন ‘টিকফা’ তথা TICFA বা Trade and Investment Co-operation Framework Agreement (‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি) হিসাবে আখ্যায়িত করার হচ্ছে।
২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তিটি স্বাক্ষর করে।
চুক্তিটি কার জন্য?
চুক্তিটি আমেরিকার সরকারের সঙ্গে
বাংলাদেশ সরকারের। এই চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র করেছে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও।
চুক্তিটির ধারা উপধারা ও আমেরিকার তৈরি। আমেরিকা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে
নাছোড়বান্দা এবং তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এজন্য সে বাংলাদেশের
ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে। এর মাঝে এদেশে ও আমেরিকায় কয়েক দফা সরকার বদল
হয়েছে। কিন্তু ‘টিফা’ চুক্তির বিষয়টি সব আমলেই
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়ে থেকেছে। তারা এমনও বলেছে
যে, ‘টিফা’ চুক্তি স্বাক্ষর না করলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পরবে। যেহেতু বাণিজ্য ও
বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ও আধিপত্য
প্রশ্নাতীত এবং এই অসামঞ্জস্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগের’ স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে করা চুক্তিটির
দ্বারা প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের একতরফা সুবিধা
প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হবে এই সমালোচনা নিরসনের জন্য ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ’-এর সাথে ‘সহযোগিতা’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু
চুক্তিতে যে সব প্রস্তাবনা ও ধারা রয়েছে সেগুলোর জন্য চুক্তিটি অসম ও মার্কিন
স্বার্থবাহী।
খ)
টিকফার
বিষয়বস্তু / টিকফা
চুক্তিতে কী আছে?
‘টিকফা’ চুক্তিতে কি কি ধারা রয়েছে তা
দেশবাসী জানে না। এই চুক্তি নিয়ে চরম গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে। ২০০৫ সালে টিফার
চুক্তি সংক্রান্ত কিছু তথ্য ফাস হয়ে যায়, যেটাতে
দেখা যায় অন্যান্য দেশে যে সমস্ত টিফা চুক্তি হয়েছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের ধারা
উপধারা গুলো মিলে যায়। এই আলোচনা সেই ফাস হওয়া ড্রাফটের উপর করা হয়েছে। যদিও
সেই ড্রাফ্ট পরিবর্তিত হয়ে থাকতে পারে তবে মুল ভাবনা এই আলোচনার বাইরে যাবেনা
বলেই মনে হচ্ছে। এই চুক্তির খসড়ায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার
মাধ্যমে উভয় দেশের বন্ধন সুদৃঢ় করার উল্লেখ থাকলেও চুক্তির বিভিন্ন প্রস্তাবনায়
এবং অনুচ্ছেদে বাজার উন্মুক্তকরণ এবং সেবা খাতের ঢালাও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতসমূহে বিশেষ করে সেবা খাতগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। চুক্তির
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য
উদারনৈতিক নীতি গ্রহণ করবে। বেসরকারি খাতের বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে
এবং উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত “ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন” প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের জন্য
প্রয়োজনীয় কৌশল ও পরামর্শ সরবরাহ করবে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের
ক্ষেত্রে শুধু সার্ভিস সেক্টরের কথা উল্লেখ রয়েছে, ‘পণ্য’ উৎপাদনের বিষয়টি সংযুক্ত রাখা
হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করবে, তা শুধু সেবা খাতেই। তারা কোনো
পণ্য এ দেশে উৎপাদন করবে না। চুক্তির এসব ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য দেশের বাজার
উন্মুক্ত করে দিবে এবং বিদ্যমান শুল্ক এবং অশুল্ক বাধাসমুহ দূর করতে বাধ্য থাকবে।
বাংলাদেশকে দেশীয় শিল্পের/কোম্পানির প্রতি সুবিধা প্রদানকারী বাণিজ্য সংক্রান্ত
অভ্যন্তরীণ সংরক্ষন নীতি প্রত্যাহার করতে হবে। টিকফা চুক্তিতে বলাই আছে বাংলাদেশ
১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরিত “দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি” অনুযায়ী
মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির উপর কোন কর আরোপ করতে পারবে না
এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই চুক্তির
মাধ্যমে বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষাসহ মার্কিন কোম্পানিগুলোকে সেবাখাতে বাণিজ্যের
জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিয়ে দেশের জ্বালানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেক্টরকে মার্কিন
পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। চুক্তির প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে
দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা অনুসারে কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাসকরণ এবং মুক্তবাজার
অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া টিকফা চুক্তির অন্যতম দিক হচ্ছে মেধাসত্ব আইনের
কঠোর বাস্তবায়ন।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ টিফা চুক্তি(খসড়া)
(৩০ জানুয়ারী ২০০৫ সালে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্ভাব্য Trade
and Investment Framework Agreement
বা TIFA
চুক্তির খসড়া)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার-
১) দুই দেশের মধ্যকার
বন্ধুত্বের বন্ধন ও সহযোগিতার চেতনা উন্নত করার আকাঙ্খা পোষণ করে;
২) ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য
ও বিনিয়োগ এর মাধ্যমে উভয় দেশের জনগণের বৃহত্তর কল্যানের জন্য কাজ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ;
৩) উভয় দেশের
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক আন্ত:সম্পর্ক আরো এগিয়ে নেয়ার আকাঙ্খা পোষণ
করে;
৪) আন্তর্জতিক বাণিজ্য
ও বিনিয়োগে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির আকাঙ্খা পোষণ করে;
৫) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
ও বিনিয়োগের অবাধ পরিবেশ তৈরীর গুরুত্বকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
৬) উভয় পক্ষের জন্যই
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য
কার্যক্রম বৃদ্ধি লাভজনক এবং সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা উভয় পক্ষকেই এইসব
সুফল থেকে বঞ্চিত করে- এই বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
৭) বিশ্ব বাণিজ্য
সংস্থায়(WTO) উভয় দেশের সদস্য পদের বিষয়টিকে বিবেচনায় রেখে এবং
WTO এর
প্রতিষ্ঠাতা চুক্তি Marrakesh Agreement এবং অন্যান্য চুক্তি ও সমোঝাতা
এবং এর সাথে সম্পর্কিত ও এর পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় থাকা অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট
ইত্যাদির আওতার মাঝে প্রত্যেক পক্ষের নিজস্ব অধিকার ও বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলোকে
লক্ষ্য রেখে;
৮) প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাণিজ্য বিকাশ, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং
অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করা ইত্যাদির জন্য দেশী এবং বিদেশী
ঊভয় ধরণের বেসরকারী বিনিয়োগের
আবশ্যিক ভূমিকার বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
৯) দুই দেশের মধ্যকার
বেসরকারী খাতের কণ্ট্রাক্ট কে উৎসাহিত করা এবং সুবিধাদি দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে;
১০) বাণিজ্য ও বিনিয়োগ
বিষয়ক সমস্যাগুলোর যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের আকাঙ্খাকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
১১) বিনিয়োগ বিষয়ে
পারস্পরিক অনুপ্রেরণা এবং সংরক্ষণের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশের মাঝে মার্চ ১২, ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরকৃত চুক্তির (Bilateral Investment
Treaty) স্বীকৃতি
প্রদান করে;
১২) এই চুক্তি
প্যারাগ্রাফ ১১ তে উল্লেখিত চুক্তির আওতায় উভয় পক্ষের অধিকার ও বাধ্যবাধকতাগুলোকে
অস্বীকার করে না;
১৩) দ্বি-পাক্ষিক
সম্পর্ক ও উভয়ের অর্থনীতিতে সেবা খাতের বাণিজ্য বৃদ্ধির গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার
বিষয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে;
১৪) উভয় দেশের বাজারে
প্রবেশের সুবিধাদি বৃদ্ধি করার জন্য অ-শুল্ক বাধা দূর করার প্রয়োজনীয়তা এবং এর
ফলে পারস্পরিক সুফল পাওয়ার বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখে;
১৫) বুদ্ধিবৃত্তিক
সম্পত্তির অধিকার বা intellectual property rights (Trade-Related Aspects of
Intellectual (Trade-Related Aspects of Intellectual Property Rights
(TRIPS) বিষয়ক
চুক্তি বা অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি রক্ষার প্রচলিত নীতি ) এর পর্যাপ্ত এবং
কার্যকর প্রয়োগ এবং সুরক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করে।
১৬) প্রত্যেক দেশের নিজ
নিজ শ্রম আইনের পর্যাপ্ত ও কার্যকর প্রয়োগ এবং সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক ভাবে
স্বীকৃত শ্রমিক ব্যবস্থাপনা (labor standards) আরও ভাল ভাবে মেনে চলা
গুরুত্ব স্বীকার করে;
১৭) টেকসই উন্নয়নের
জন্য প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক এবং পরিবেশবিষয়ক নীতি মালা নিশ্চিত করতে ইচ্ছা পোষণ
করে;
১৮) আকাঙ্খাকা পোষণ
করে যে এই কাঠামোগত চুক্তি (Framework Agreement ) দোহা উন্নয়ন এজেন্ডা
সফলভাবে পরিপূর্ণ করার লক্ষে যৌথ প্রচেষ্টা জোরদার করার মাধ্যমে বহুপাক্ষিক
বাণিজ্যকে আরও শক্তিশালী করবে; এবং
১৯) উভয় দেশের বাণিজ্য
উদারীকরণ ও নিজেদের মধ্যকার বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দ্বি-পাক্ষিক প্রকৃয়া প্রতিষ্ঠা
উভয় দেশের জন্য লাভজনক- এই বিষয়টিকে বিবেচনায় রাখে।
এ লক্ষ্যে উভয় পক্ষ
নিম্নোক্ত বিষয়ে একমত পোষণ করছেঃ
আর্টিকেল একঃ
চুক্তিকারী পক্ষদ্বয় এই চুক্তির আওতায় নিজ নিজ দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নের
মাধ্যমে পণ্য ও সেবা খাত সম্প্রসারিত করবে। তারা নিজেদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও
চাহিদা মোতাবেক সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের লক্ষ্যে পণ্য ও সেবা খাত অধিকতর নিরাপদ ও
দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য সহজতর করার উদ্দেশ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আর্টিকেল দুই:
চুক্তিকারী পক্ষদ্বয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত একটি ‘কাউন্সিল’ গঠন করবে। কাউন্সিলে
দুই দেশেরই প্রতিনিধিত্ব থাকবে। বাংলাদেশ পক্ষের সভাপতি থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের
বাণিজ্যমন্ত্রী এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী হবে
United States Trade Represntative (USTR)। দুই পক্ষই তাদের যথাযথ পরিস্থিতি
ও প্রয়োজনানুযায়ী সরকারের অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠনগুলো থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা
গ্রহণ করতে পারবে। কাউন্সিল নিজ কাজের সুবিধার্থে ঐকমত্য সহকারে অথবা আলাদাভাবে Joint
Working Group প্রতিষ্ঠা
করতে পারবে।
আর্টিকেল তিনঃ
কাউন্সিলের উদ্দেশ্যাবলী হবে নিম্নরূপঃ
১·বাণিজ্য ও বিনিয়োগ
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্র সনাক্তকরণ এবং যথাযথ ফোরামে
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
২·চুক্তির আওতার বাইরে
বিশেষ বাণিজ্য কিংবা বিনিয়োগ ক্ষেত্রে পক্ষদ্বয়কে চুক্তির নিয়মাবলী অনুযায়ী
সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করা।
৩·দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য ও
বিনিয়োগ সম্প্রসারণে বাধাসমূহ চিহ্নিতকরণ ও অপসারণ
৪·কাউন্সিলের সাথে যুক্ত
বিষয়ে চুক্তিকারী পক্ষদ্বয়কে যথাযথ ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর
থেকে প্রয়োজনীয় উপদেশ
গ্রহণে সাহায্য করা।
আর্টিকেল চারঃ
দ্বি-পাক্ষীয় এই চুক্তির আওতার বাইরে কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কাউন্সিল
পক্ষদ্বয়ের যে কোন একটির অনুরোধে সুবিধাজনক সময়ে ও স্থানে আলোচনায় বসতে পারে।
কোন অবস্থাতেই কোন পক্ষ এককভাবে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না যা
দ্বি-পাক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
আর্টিকেল পাঁচঃ এই
চুক্তিটি কোন পক্ষের প্রচলিত অভ্যন্তরীণ আইন এবং কোন পক্ষের স্বাক্ষরিত অন্যকোন
চুক্তির ফলে প্রাপ্য অধিকার ও দায়বদ্ধতাকে ব্যাহত করবে না।
আর্টিকেল ছয়ঃ চুক্তি
স্বাক্ষরের দিন থেকেই এটা দুই দেশে কার্যকর বলে গণ্য করা হবে।
আর্টিকেল সাতঃ এই
চুক্তি দ্বি-পাক্ষীয় সম্মতিতে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কিংবা এক পক্ষ দ্বারা অপর পক্ষকে
ছয় মাসের পূর্ব নির্ধারিত নোটিশ ব্যতিরেকে, য়থাশক্তিতে বলবৎ থাকবে।
গ)
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে টিকফার প্রভাব:
টিকফা চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে সব প্রভাব পড়তে পারে
তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মার্কিন আধিপত্য নিরঙ্কুশ হবে:
এ চুক্তিতে উদার বাণিজ্যনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং
মেধাসত্ত্ব আইনের বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিকে
নিয়ন্ত্রণের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে।
এ চুক্তির খসড়ায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহযোগিতার
মাধ্যমে উভয় দেশের বন্ধন সুদৃঢ় করার উল্লেখ থাকলেও চুক্তির বিভিন্ন প্রস্তাবনায়
এবং অনুচ্ছেদে বাজার উন্মুক্তকরণ এবং সেবাখাতের ঢালাও বেসরকারিকরণের মাধ্যমে
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতগুলো বিশেষ করে সেবা খাতগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে।
চুক্তির ৫ এবং ১৯ নম্বর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় রাষ্ট্রই
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য উদারনৈতিকনীতি গ্রহণ করবে। প্রস্তাবনা ৮ এ
প্রাইভেট খাতের বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং অনুচ্ছেদ ৩ অনুযায়ী উভয়
দেশের উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন’ প্রাইভেট সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় কৌশল ও পরামর্শ
সরবরাহ করবে। অনুচ্ছেদ ১-এ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু
সার্ভিস সেক্টরের কথা উল্লেখ রয়েছে, ‘পণ্য’ উৎপাদনের বিষয়টি সংযুক্ত
রাখা হয়নি। চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ করবে,
তা শুধু সেবা খাতেই। তারা কোন পণ্য এ দেশে
উৎপাদন করবে না। চুক্তির এসব ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক
কোম্পানির বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য দেশের বাজার উন্মুক্ত করে দিবে এবং বিদ্যমান
শুল্ক এবং অশুল্ক বাধাগুলো দূর করতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশকে দেশীয়
শিল্পের/কোম্পানির প্রতি সুবিধা প্রদানকারী বাণিজ্য সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ সংরক্ষণ
নীতি প্রত্যাহার করতে হবে। টিকফা চুক্তিতে বলাই আছে, বাংলাদেশ ১৯৮৬ সালে স্বাক্ষরিত ‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি’ অনুযায়ী মার্কিন বিনিয়োগকারীদের অর্জিত মুনাফা বা পুঁজির
ওপর কোন কর আরোপ করতে পারবে না এবং বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয়া হলে তাদের
ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
এ চুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষাসহ মার্কিন
কোম্পানিগুলোকে সেবাখাতে বাণিজ্যের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশের জ্বালানি,
গ্যাস, বিদ্যুৎ, বন্দর, টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন ইত্যাদি সেক্টরকে মার্কিন পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত
করে দিতে হবে। ফলে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলে দেশের সেবাখাতগুলো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ
থেকে মুক্ত হয়ে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাবে। এতে করে দেশীয়
কোম্পানিগুলোর স্বার্থও বিঘ্নিত হবে। অবাধ মুনাফা অর্জনের জন্য বিদেশি
কোম্পানিগুলো সেবা ও পণ্যের দাম অত্যধিক বৃদ্ধি করবে। টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, চিকিৎসা, শিক্ষা, বন্দর প্রভৃতির
ব্যবহার মূল্য বহুগুণ বেড়ে যাবে। সেবাখাতে বিদেশি প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর অবাধ ও
বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ প্রদান করলে বাংলাদেশ তার কল্যাণমূলক রাষ্ট্রনীতির
আওতায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষকে কম মূল্যে
সেবাদানের যেসব কর্মসূচি নিয়ে থাকে তা সংকুচিত হবে অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে
গরিব এবং সাধারণ মানুষের জীবনধারণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। চুক্তির ১৮ নম্বর
প্রস্তাবনা অনুযায়ী বাংলাদেশকে দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা অনুসারে কৃষিতে ভর্তুকি
হ্রাসকরণ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
নিজে সুকৌশলে বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করে অনুন্নত দেশকে বাণিজ্য সুবিধা
প্রদান থেকে বিরত রাকছে।
দোহা এজেন্ডা অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষিতে ৫% এর বেশি ভর্তুকি
দিতে পারছে না অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই কৃষিতে ১৯% এর বেশি ভর্তুকি দিয়ে তাদের কৃষি
ব্যবস্থাকে সুরক্ষা দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্যের দাম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি
পাচ্ছে। অন্যদিকে দোহা নীতি অনুসারে আমেরিকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৭% পণ্যের
ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা। আমেরিকা ঠিকই
বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিয়েছে তবে তাতে
ওইসব পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যার রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। বাংলাদেশের প্রধান
রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাককে এর বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র নিজে কিন্তু
বাণিজ্য সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করছে অথচ আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলোকে বাণিজ্য
উদারনীতি গ্রহণে নানা চুক্তির মাধ্যমে বাধ্য করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের দেশে বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়বে, সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়বে আমাদের পণ্য রপ্তানিও। এশিয়ার দুটি প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি গণচীন এবং ভারত তার রপ্তানির যথাক্রমে ২১% এবং ১৯% পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করলেও তারা এ চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির সম্পর্ক নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে প্রধান বাধা হচ্ছে শুল্ক বাধা। বর্তমানে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৫.৩% শুল্ক দিতে হয় অন্যদিকে চীনকে পরিশোধ করতে হয় মাত্র ৩%।তাহলে দেখা যাচ্ছে চীন টিফা চুক্তি স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম শুল্কে পণ্য রপ্তানি করতে পারছে। তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের লোভ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য এদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে কিন্তু টিকফা অ্যাগ্রিমেন্টে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কোন নিশ্চয়তা রাখা হয়নি কারণ চুক্তির ১৪ নম্বর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে উভয় দেশ নিজ নিজ বাজারে পণ্য প্রবেশে নন ট্যারিফ বা অশুল্ক বাধা দূর করবে। কিন্তু বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অশুল্ক বাধা খুব সামান্যই।
“যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে সেই অর্থে বাংলাদেশ জিএসপি বা শুল্কমুক্ত
সুবিধা পায় না। বরং প্রায় ৭৫ কোটি ডলার শুল্ক আমাদের কাছ থেকে পায় যুক্তরাষ্ট্র।
দেশটিতে বাংলাদেশের মোট রফতানি প্রায় ৪৮০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে মাত্র দশমিক ৫
শতাংশ পণ্য জিএসপি সুবিধা পায়। কাজেই দেশটি জিএসপি সুবিধা তুলে নিলেও কোনো অসুবিধা
হবে না।” এই কথাগুলো বিজিএমএইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম
মহিউদ্দিন এর।কিন্তু এই জিএসপি সুবিধার কথা বলে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরের ন্যায্যতা
প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। এটা রীতিমত ধোঁকাবাজি !!
এল ডি সি’র নেতা হিসেবে বাংলাদেশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে:
অনেক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞের মতে, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বাইরে
স্বল্পোন্নত দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্যই আমেরিকা সহযোগিতামূলক উদ্যোগের
ছদ্মাবরণে টিফা বা টিকফার মতো দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো করার চেষ্টা করছে। যদি
স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায় তবে আন্তর্জাতিক
বহুপাক্ষিক ফোরাম ডবিস্নউটিও এ আমেরিকা তার আধিপত্যবাদী বাণিজ্যনীতি বাধাহীনভাবে
বাস্তবায়ন করতে পারবে। এ লক্ষ্যেই পাকিস্তান, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ইরাক, উরুগুয়েসহ বিশ্বের
৩০টিরও বেশি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই টিফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নেতা হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন
আন্তর্জাতিক ফোরামে তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছে। বিশ্বব্যাপী
পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিপরীতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার
জন্য এসব ফোরামে বাংলাদেশ যাতে কোন ভূমিকা না রাখতে পারে সেজন্য বাংলাদেশকেও টিকফা
চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে যুক্তরাষ্ট্র। কেননা টিকফা
স্বাক্ষর হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া আর সম্ভব
হবে না।
পেটেন্ট আইনের বাস্তবায়ন কৃষি, ওষুধ শিল্প, কম্পিউটার সফটওয়্যারসহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত হুমকির মুখে পড়বে:
টিকফা চুক্তির অন্যতম দিক হচ্ছে মেধাসত্ত্ব আইনের কঠোর বাস্তবায়ন। এ আইনটি
উন্নত দেশগুলোর মালিকানাধীন বহুজাতিক কোম্পানির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক হাতিয়ার
হিসেবেই কাজ করবে, যাতে দরিদ্র দেশগুলোর কাছ থেকে অবাধে
মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা লুণ্ঠনের আইনি বৈধতা পাওয়া যায়। উন্নত প্রযুক্তি এবং উৎপাদন
পদ্ধতির অধিকারী হওয়ার পর তারা এ জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। এর মাধ্যমে তারা
চায় যেন অবশিষ্ট বিশ্বপ্রযুক্তি ও উৎপাদনের জন্য তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকে এবং
তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে পেটেন্ট আইনের যথাযথ
বাস্তবায়নের অনুপস্থিতির কারণে বহুজাতিক মার্কিন কোম্পানির অবাধ বাণিজ্য
বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। টিফা চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই
মেধাসত্ত্ব আইন মানতে বাধ্য করছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। টিকফা চুক্তির ফলে
বাংলাদেশকে ২০১৬ সালের আগেই মেধাসত্ত্ব আইন মেনে চলতে হবে, কেননা চুক্তির ১৫ নম্বর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে বাণিজ্য সম্পর্কিত মেধাসত্ত্ব
অধিকার (IPR) এবং অন্যান্য প্রচলিত মেধাসত্ত্ব আইনের যথাযথ এবং কার্যকরী রক্ষণাবেক্ষণ ও
বাস্তবায়ন করতে হবে।
দোহা ঘোষণা ২০০০ অনুযায়ী বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার আওতায় বাণিজ্যবিষয়ক মেধাসম্পদ
স্বত্ব চুক্তি অনুসারে স্বল্পোন্নত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৩ সাল পর্যন্ত
বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় এবং ২০১৬ পর্যন্ত ওষুধের ক্ষেত্রে মেধাসত্ত্ববিষয়ক বিধিনিষেধ
থেকে ছাড় পেয়েছে এবং এই সুবিধা গ্রহণ করে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল
কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পেটেন্ট করা ওষুধ উৎপাদন এবং রপ্তানি করতে পারছে। এমনকি
প্রয়োজন হলে এ সময়সীমা আরও বাড়ানো হতে পারে। কিন্তু টিকফায় সে ধরনের কোন সুযোগ
রাখা হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প, কম্পিউটার
সফটওয়্যারসহ গোটা তথ্যপ্রযুক্তি খাত আমেরিকার কোম্পানিগুলোর পেটেন্ট, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির লাইসেন্স খরচ বহন করতে গিয়ে
অভূতপূর্ব লোকসানের কবলে পড়বে। ফলে বিভিন্ন পণ্য এবং প্রযুক্তির দাম অভাবনীয়ভাবে
বেড়ে যাবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই দেশকে সফটওয়্যার লাইসেন্স ফি বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। মেধাসত্ত্ব আইন কার্যকর হলে
বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক ওষুধ তৈরি করতে পারবে না। আমাদের কয়েকগুণ বেশি
দামে বিদেশি কোম্পানির পেটেন্ট করা ওষুধ খেতে হবে। বাংলাদেশ ওষুধ শিল্পে রপ্তানি
সম্ভাবনা হারাবে। দরিদ্ররা ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাবে। আমাদের জনস্বাস্থ্য
মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেননা দেশীয়
ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজ দেশেই তাদের ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে
অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে। ফলে অনেক মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।
তাছাড়া ওষুধের পেটেন্ট আগে দেয়া হতো সাত বছরের জন্য, এখন বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস আইনে তা আরও বাড়িয়ে ২০ বছর করা হয়েছে। অর্থাৎ
আবিষ্কারক কোম্পানি সুদীর্ঘ ২০ বছর ধরে নিজের ইচ্ছামতো দামে ওষুধটির একচেটিয়া
ব্যবসা করে অবাধে মুনাফা লুট করবে। পেটেন্ট আইন বাস্তবায়ন আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্য
এবং কৃষিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
পেটেন্টের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এখন আর শুধু সামরিক এবং অর্থনৈতিক
ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয় বরং ফল ফসল এবং গাছ-গাছড়ার ওপরও বিস্তৃত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট আইনে বলা আছে, ‘কোন কিছুর পেটেন্টের
বেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অলিখিত উৎসের অনুসন্ধানের কোন বাধ্যবাধকতা নেই।’
এর মানে হচ্ছে হাজার হাজার বছর ধরে উন্নয়নশীল দেশের প্রচলিত
উৎপাদন প্রণালি, জীববৈচিত্র্য, কৃষকদের নিজস্ব শস্যবীজ ইত্যাদি শুধুমাত্র প্রযুক্তি এবং অর্থের জোরে পেটেন্ট
করে নিতে পারবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।
বাংলাদেশ, ভারত, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন
দেশের নিজস্ব জীববৈচিত্র্যের অনেক জীব-অণুজীব এবং উদ্ভিদ প্রজাতি
এখন বহুজাতিক কোম্পানির পেটেন্টের দখলে। ভারত উপমহাদেশের শতাধিক গাছগাছড়া যুক্তরাষ্ট্রের
পেটেন্ট অফিসে রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় রয়েছে। নিম, হলুদ, মসলা, থানকুনি, চিরতার রস, ট্রাইফোলিয়েট অরেঞ্জসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ফলদ
এবং ওষুধি গাছ যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশের কোম্পানির পেটেন্ট
আগ্রাসনের শিকার হতে চলেছে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তাদের উন্নত জেনেরিক টেকনোলজির
মাধ্যমে ডিএনএ ফিঙ্গার প্রিন্ট নির্ণয় করে অন্য দেশের জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিজ
সম্পদকে নিজের বলে পেটেন্ট করিয়ে নিচ্ছে। কৃষিতে পেটেন্ট বাস্তবায়ন হলে কৃষকদের
শস্যবীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন এবং রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার কেড়ে নেয়া হবে। মেধাসত্ত্ব আইন অনুযায়ী
রয়্যালিটি পাবে আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আর ধ্বংস হবে দেশি প্রজাতি,
পরিবেশ এবং কৃষি উৎপাদন কাঠামো। বীজ এবং কৃষি পণ্যের দাম
অনেকগুণ বেড়ে যাবে বলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
এছাড়া টিকফার প্রস্তাবনায় মানবাধিকার, শ্রমের মান এবং
শ্রমজীবীদের অধিকার ও পরিবেশগত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তার লক্ষ্য শ্রমজীবীদের
অধিকার প্রতিষ্ঠা নয় বরং এগুলোকে নন-ট্যারিফ বাধা হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে
বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
থাইল্যান্ড ও শ্রীলংকার অভিজ্ঞাতায় টিফা:
থাইল্যান্ড টিফা চুক্তি
করে ২০০২ সালের অক্টোবরে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই থাইল্যান্ডকে বাধ্য করা হতে
থাকে আমেরিকার কর্পোরেট মনোপলির স্বার্থে এর বিভিন্ন সেবা খাত বেসরকারী করে দিতে। Electricity
Generating Authority of Thailand (EGAT) বেসরকারী করণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
শুধু তাই নয়, EGAT বিক্রির পরমর্শক দের মধ্যে অন্যতম কর্পোরেশন Morgan
Stanley, Citigroup and JP Morgan Chase and Co. অন্যান্য রাষ্ট্রায়াত্ব
প্রতিষ্ঠান যেমন: Metropolitan Waterworks Authority, Provincial Waterworks
Authority, the Government Pharmaceutical Organization, the Port Authority of
Thailand, the Expressway and Rapid Transit Authority of Thailand ইত্যাদি বিক্রি করে
দেয়ার উদ্যোগ নেয়। জনগণের তীব্য আন্দোলন সংগ্রাম এর কারণে এগুলো এখন বাস্তবায়ন
করতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ১৯৯৯ সাল থেকে থাইল্যান্ড জেনিটিক্যালী ইঞ্জিনিয়ারড বীজ আমদানীর
উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, মুক্ত বাণিজ্যের নামে মনসান্টোর বিটি কটন আর রাউন্ড আপ রেডি কর্ন
থাইল্যান্ডের বাজারে ঢুকানোর জন্য আমেরিকা ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করছে। আবার
ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস এর আওতায় থাইল্যান্ডের সুগন্ধি চাল জেসমিন এর ও
পেটেন্ট করার চেষ্টা চলে। আবার শ্রীলঙ্কার সাথে ২০০২ সালে টিফা চুক্তির সময়
আমেরিকা গার্মেন্টস পণ্যের কোটা মুক্ত সুবিধার কথা বললেও বাস্তবে তা না দেয়ার জন্য
নানান শর্ত চাপিয়ে দেয়-যেমন রুলস অব অরিজিনের এমন শর্ত যে শ্রীলঙ্কার উৎপাদিত
গার্মেন্টস পন্য তেরী হতে হবে আমেরিকান ফ্যাব্রিক্স ব্যবহার করে, ইন্টেলেকচুয়াল
প্রপার্টি রাইটস বাস্তবায়ন ইত্যাদি। ২০০৩ সালে পার্লামেন্ট এ ইন্টেলেকচুয়াল
প্রপার্টি রাইটস সম্পর্কিত আইন পাশ করতে গেলে তীব্র বাধার সম্মুখীন হয় এবং এক
পর্যায়ে আদালতে মামলা পর্যন্ত হয় এবং আদালত মামলাকারীর পক্ষেই রায় দেন। সর্বশেষ
২০০৯ সালে ৭ম টিফা বৈঠকে আমেরিকা আবার ট্রিপস বাস্তবায়নের ব্যাপারে শ্রীলংকাকে চাপ
দেয় এবং সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জেনিটিক্যালী মডিফাইড ফুড আমদানীর উপর
শ্রীলংকার যে নিষেধাজ্ঞা আছে সেটাও তুলে নেয়ার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করে।
No comments:
Post a Comment